Tuesday, 29 June 2021

গল্পঃ ইফতারের আনন্দ

 ইফতারের আনন্দ
খাদিজা নাওরীন

সূর্যটা পশ্চিম আকাশে হেলে পড়ছে। পাখিদের কিচির-মিচির বাড়ছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রফিক সাহেব অস্ফুট উচ্চারণে বলে উঠলেন, "আ-রো এক ঘন্টা বাকি আছে ইফতারের।" পেটের ভেতরটা চোঁ চোঁ করে উঠল তার। হাতের নাগালেই পানির জগ আর গ্লাস রাখা আছে, কিন্তু খাওয়া যাবেনা একদম। কারণ, আর কেউ না দেখলেও তিনি তো ঠিকই দেখে ফেলবেন, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আর রোযার প্রতিদান তো তারই হাতে। আল্লাহ বলেন, "রোযা আমার জন্য, আর আমিই এর প্রতিদান দেব।"
রান্নাঘর থেকে লোভনীয় ঘ্রাণ ভেসে আসছে রফিক সাহেবের কাছে, স্ত্রী তানিয়া ইফতারের জন্য রান্না করছেন। প্রতিদিন এ সময়টাতে সারা ঘর ভেসে বেড়ায় এমন ঘ্রাণ, ভালোই লাগে রফিক সাহেবের। কিছুক্ষণ রুমে পায়চারি করে ক্লান্ত দেহটাকে এলিয়ে দিলেন বিছানায়। তার সাড়ে তিন বছরের ছেলে ইফাদ গিয়ে বাবার শিয়রে বসল, বসে বাবার চুলগুলো এলোমেলো করতে লাগলো, ভালোই লাগছিল রফিক সাহেবের। ছোট্ট এই হাতগুলোর ছোঁয়াতে ঘুমে চোখ বুজে আসল তার। ইফাদ আরো কয়েক মিনিট বাবাকে এরকম আদর মাখিয়ে দিয়ে রান্নাঘরে মায়ের কাছে গিয়ে বলল, “ মা, আমি সেমাই খাব”। মা তানিয়া তখন রান্নাবান্নায় ব্যস্ত, অসময়ে ছেলের এই সেমাই খাওয়া শুনে খানিকটা ভ্রু কুচকে উঠল তার। ছেলেকে আদর মাখা কন্ঠে বললেন, “ বাবা, ইফতারের পর তোমাকে সেমাই বানিয়ে দেই? মা পিঁয়াজু, আলুচপ, বেগুনি...... এগুলো বানিয়েছি। এসব খাও?” “ না, না খাবোনা, আমি সেমাই খাব”, এই বলে ইফাদ চিল্লাতে লাগলো।
ছেলের চিৎকার শুনে বাবা রফিকের ঘুম ভেঙ্গে গেল। এলোমেলো পায়ে রান্নাঘরে এসে স্ত্রীকে ছেলের কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। শুনে তিনি ছেলেকে কোলে নিয়ে আদর করেত লাগলেন। কিন্তু “ সেমাই খাব , সেমাই খাব” বলে ইফাদ কান্না করতেই আছে।
একরকম বাধ্য হয়েই তানিয়া ছেলের জন্য সেমাই বানালেন। সেমাই দেখে তখন ইফাদের সে কি আনন্দ! স্বামী রফিকের কাছে ছেলেকে খাওয়ানোর দায়িত্ব দিয়ে তানিয়া রান্না ঘরে চলে গেলেন। ইফতারের আর বেশি সময় বাকি নেই।
খুশি খুশি ভাব নিয়ে ইফাদ সেমাই খাচ্ছে । তাঁর সেই আনন্দিত মুখটার পানে চেয়ে ভাবনায় ডুবে গেলেন রফিক সাহেব। স্মৃতিপটে ভাসতে লাগল আজ দুপুরের ঘটনা। মসজিদ থেকে যোহরের নামাজ আদায় করে ফিরছেন তিনি। আকমল আলীর বাড়ির কাছে আসতেই শুনতে পেলেন ছোট্ট একটি কন্ঠ, “ মা, আমি ভাত খাব, ও মা , ভাত দাও”। সাথে সাথেই আরেকটি মহিলা কন্ঠ শোনা গেলো, “ ভাত না, আমার মাথা খাও, বাপ তো মরে মরে বেঁচে আছেন, আর এখন জ্বালা আমার”।
আকমল আলী রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতো। হঠাত প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে এখন শয্যাশায়ী। কাজ-কাম তো দূরের কথা, তার স্ত্রী এ বাড়ী-ও বাড়ী কাজ করে যা পায় তাই দিয়ে সংসার চলে।
ইফাদের আবদার আর আকমল আলীর বাচ্চার আবদারের পার্থক্য অনেক। এই পার্থক্যটুকু রফিক সাহেবের মনে যেন অনবরত ঘা দিচ্ছে।
তিনি উঠে ধীর পায়ে রান্না ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। তানিয়া তখন রান্নাবান্না নিয়ে খুব ব্যস্ত। তাঁর কপালে আর নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম চিক চিক করছে। স্বামীকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে না থাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু লাগবে?” “তুমি তো প্রতিদিনই একটু বাড়িয়েই ইফতার রেডি করো, আজ ও কি সেরকম করেছো? জিজ্ঞেস করলেন রফিক সাহেব। হঠাৎ স্বামীর এরকম প্রশ্নে তানিয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালেন এবং বললেন, হ্যাঁ, কিন্তু কেন?” তানিয়া সবসময়ই ইফতারের জন্য একটু বেশিই রান্না করেন, যদি কোন মেহমান আসেন অথবা কোন গরিব এসে দরজায় দাঁড়ায়, তখন তাকে যেনো খালি পেটে ফিরে যেতে না হয় এই ভেবে”। স্বামী রফিক কখনও এ নিয়ে কোনো কিছু বলেন না। বরং এ ব্যাপারটা ভালোই লাগে তাঁর। হঠাৎ স্বামীর এই প্রশ্নে তানিয়া ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন।
“না মানে...” বলে রফিক সাহেব দুপুরের ঘটনাটা খুলে বললেন। এরপর বললেন, “একটা প্যাকেটে কিছু খাবার দাও তো, আকমলদের বাড়িতে দিয়ে আসি, না জানি আজ ওরা ইফতার তৈরি করেছে কি না!”
তানিয়া খুব ভালোভাবে ইফতার রেডি করে স্বামীর হাতে তুলে দেন। রফিক সাহেব সে খাবার নিয়ে ছুটেন আকমলদের বাড়ির উদ্দশ্যে।
খাবার দেওয়ার পর পাঁচ-ছয় বছরের একটি মেয়ে খাবারটি দেখেই বলে ওঠে, “ও মা, দুপুরে ও আমাকে ভাত দাওনি, এবার দাও না গো মা ......,” রফিক সাহেব আর শুনতে চান নি, উনার দু চোখ যেন পানিতে ভিজে আসছে।
বাড়িতে এসে বারান্দায় পা দিতেই পিছন থেকে একটি কন্ঠ শোনা যায়, “বাবা গো, কিছুটা সাহায্য করো”। রফিক সাহেব ফিরে তাকাতেই দেখেন, জীর্ণ-শীর্ণ এক বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে, বয়সের ভারে নুঁয়ে পড়েছেন তিনি! রফিক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “বাড়ি কোথায়?” “এইতো পাশের গ্রামে”। একটু ইফতারের খুঁজে বেরিয়েছিলাম, কিন্তু কোথাও পাইনি! তাই এতদূর আসা” বললেন বৃদ্ধ। “আসুন, আমার সাথে ইফতার করে নিন”- বললেন রফিক। বৃদ্ধ বললেন, “ না বাবা, অসুস্থ, বুড়ো, রোযাদার বউটা অপেক্ষা করছে আমার জন্য”। “আচ্ছা দাড়ান”- বলে রফিক ঘরে ঢুকে তানিয়াকে সব বললেন।
তানিয়া অল্প কিছু খাবার নিজেদের জন্য রেখে প্রায় সব খাবার প্যাকেটে পুরে স্বামীর হাতে তুলে দিতে দিতে বললেন, “আমরা পরে রান্না করে খেতে পারব, কিন্তু এদের হয়তো আজ উপোস থাকতে হতো”!
প্যাকেটটা পেয়ে বৃদ্ধ যার পর নাই খুশি হয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে করতে চলে গেলো।
তানিয়ার মুখটা কেমন যেনো গম্ভীর হয়ে আছে । রফিকের জিজ্ঞাসায় সে বললো, “আকমল কিংবা ঐ বৃদ্ধের বাড়িতে আজ সেহরি রান্না হবে কিনা কে জানে! রফিক বললেন, “এটাইতো রোজার শিক্ষা , গরিব দুঃখীরা কত কষ্ট করে, কিন্তু কে তার হিসাব রাখে.........”!
“আল্লাহু আকবার.........” আজানের ধ্বনি শুনে রোজা ভাঙলেন রফিক ও তানিয়া। সারাদিনের অবসন্ন শরীরটা যেন ফিরে পেলো আপণ প্রাণ। স্বামী-স্ত্রী দুজনে অল্প খাবারটুকু ভাগাভাগি করে খেয়ে নিলেন। অল্প এই ইফতারটুকুর মধ্যে ওরা পেলো যেনো পরম এক তৃপ্তি যা ইফতারের পসরা সাজিয়ে বসে খেলেও পাওয়া যায়না!
পাশে বসা ছোট্ট ইফাদ বাবাকে জড়িয়ে ধরে হঠাৎ বলে ওঠে, “বাবা, আমি বড় হয়ে গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করব”। ছোট্ট ছেলের এমন কথায় মা- বাবা দুজনে ওর কপালে আদরের চুমো খেলেন।
০৮-০৫-২০২০
No photo description available.

No comments:

Post a Comment

কবিতা : ঈদের চাঁদ

        ঈদের চাঁদ    খাদিজা নাওরীন ঈদের ঘোষণা দিল ঐ চাঁদ উঠে আকাশে, খুশির জোয়ার চলছে তাই  বাতাসে- বাতাসে। ঐ ঈদের চাঁদে যত খুশি লুকানো! প্রকা...